• বৃহস্পতিবার, ০১ জানুয়ারী ২০২৬, ০১:১১ পূর্বাহ্ন

এক সংগ্রামী ও মহীয়সী নেত্রীর বিদায়

দর্পন ডেস্ক / ৭ পড়া হয়েছে
প্রকাশিত : বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৫

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আর নেই। রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল ভোর ৬টায় তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। দীর্ঘদিন ধরে তিনি হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস, লিভার সিরোসিস, কিডনি জটিলতাসহ নানা শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন।

খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে বুধবার থেকে তিনদিন রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হবে। এছাড়া তার জানাজার জন্য আজ সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। সাতদিনের শোক পালন করবে খালেদা জিয়ার দল বিএনপি।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আপসহীন সংগ্রাম, সাহসী নেতৃত্ব ও দীর্ঘ ত্যাগের প্রতীক হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন খালেদা জিয়া। সামরিক শাসন-পরবর্তী গণতান্ত্রিক রাজনীতির উত্তাল সময়ে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন দেশের অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। ১৯৮১ সালে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর তিনি কঠিন রাজনৈতিক বাস্তবতায় দলের দায়িত্ব নেন। নানা দমন-পীড়ন, রাজনৈতিক বৈরিতা ও ব্যক্তিগত শোককে অতিক্রম করে তিনি ধীরে ধীরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন আপসহীন নেত্রী হিসেবে। ১৯৯১ সালে গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং বহুদলীয় রাজনীতির বিকাশ হয়। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের রাজনৈতিক সংকট ও নির্বাচনী লড়াইয়েও তিনি ছিলেন রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে। বিশেষ করে ২০০১ সালে পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে অর্থনীতি, অবকাঠামো ও দারিদ্র্য বিমোচনে একাধিক উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে খালেদা জিয়াকে একাধিকবার কারাবরণ করতে হয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে দ্বন্দ্ব, মামলা ও দমন-পীড়নের মধ্য দিয়েই কেটেছে তার জীবনের বড় একটি সময়। গুরুতর অসুস্থতার মধ্যেও তিনি রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করেছেন, যা তার দৃঢ় মনোবল ও দায়িত্ববোধের পরিচয় বহন করে। দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের কাছে তিনি ছিলেন সংগ্রামের অনুপ্রেরণা, আর অনুসারীদের কাছে এক মমতাময়ী ও দৃঢ়চেতা নেত্রী। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তার নাম লেখা থাকবে একজন সংগ্রামী, মহীয়সী ও সময়ের সাহসী নেতৃত্ব হিসেবে—এমনটাই মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

এভারকেয়ার হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) গত ২৩ নভেম্বর থেকে চিকিৎসাধীন ছিলেন খালেদা জিয়া। গতকাল ভোর ৬টায় তার মৃত্যুসংবাদ নিশ্চিত করেন ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন। এ সময় হাসপাতালে খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, পুত্রবধূ ডা. জুবাইদা রহমান, নাতনি জাইমা রহমান, ছোট ছেলের স্ত্রী শামিলা রহমান সিঁথি, ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার, বড় বোন সেলিনা ইসলামসহ আত্মীয়স্বজন উপস্থিত ছিলেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সব চিকিৎসকও উপস্থিত ছিলেন এ সময়। হাসপাতালজুড়ে গতকাল দিনভরই ছিল বিএনপির জ্যেষ্ঠ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী, সমর্থক ও স্বজনদের পদচারণা।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। গতকাল এক বার্তায় রাষ্ট্রপতি এ শোক জ্ঞাপন করেন। মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘গণতন্ত্র এবং জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তার আপসহীন ভূমিকা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। জাতির এ অপূরণীয় ক্ষতির মুহূর্তে আমি মরহুমার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গ ও অনুসারীদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।’

খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও। এক শোকবার্তায় তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়ার ইন্তেকালে জাতি তার এক মহান অভিভাবককে হারাল। তার মৃত্যুতে আমি গভীরভাবে শোকাহত ও মর্মাহত।’

ড. ইউনূস বলেন, ‘খালেদা জিয়া শুধু একটি রাজনৈতিক দলের নেত্রীই ছিলেন না; তিনি ছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তার অবদান, তার দীর্ঘ সংগ্রাম এবং তার প্রতি জনগণের আবেগ বিবেচনায় নিয়ে সরকার চলতি মাসে তাকে রাষ্ট্রের অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে ঘোষণা করে। বাংলাদেশে গণতন্ত্র, বহুদলীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তার ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তার আপসহীন নেতৃত্বের ফলে গণতন্ত্রহীন অবস্থা থেকে জাতি বারবার মুক্ত হয়েছে, মুক্তির অনুপ্রেরণা পেয়েছে। দেশ ও জাতির প্রতি তার অবদান জাতি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।’

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গতকাল দুপুরে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে বলেন, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে আমি তিনদিনের রাষ্ট্রীয় শোক এবং বুধবার তার জানাজার দিনে একদিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছি।’ পরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সরকারি ছুটি ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। এতে বলা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে সরকার ৩১ ডিসেম্বর (বুধবার) নির্বাহী আদেশে এক দিনের সরকারি ছুটি ঘোষণা করল।

এর আগে গতকাল প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বিশেষ আমন্ত্রণে সভায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অংশ নেন। সভার শুরুতে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুতে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন এবং তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করে মোনাজাত করা হয়। মোনাজাত পরিচালনা করেন ধর্ম উপদেষ্টা। সভায় খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে একটি শোক প্রস্তাব গৃহীত হয়; যা পাঠ করেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং তথ্য উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান।

এদিকে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, রাষ্ট্রীয় শোকের তিনদিন দেশের সব সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব সরকারি-বেসরকারি ভবন এবং বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোতে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। একই সঙ্গে আগামীকাল দেশের প্রতিটি মসজিদে বেগম খালেদা জিয়ার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনায় বিশেষ দোয়া ও মোনাজাতের আয়োজন করা হবে। অন্যান্য ধর্মের উপাসনালয়গুলোয়ও আয়োজন করা হবে বিশেষ প্রার্থনার।

গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে গতকাল দুপুর ১২টায় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, সেলিমা রহমান, এজেডএম জাহিদ হোসেন।

পরে বৈঠকের বিষয়বস্তু নিয়ে সংবাদমাধ্যমে ব্রিফ করেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, ‘স্থায়ী কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেলা ২টায় পার্লামেন্ট ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় যে মাঠ এবং মানিক মিয়া এভিনিউর পুরো অংশজুড়ে আমাদের নেত্রীর জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এ জানাজা পড়াবেন আমাদের জাতীয় মসজিদের খতিব অর্থাৎ বায়তুল মোকাররমের খতিব। পুরো বিষয়টা সঞ্চালনা করবেন আমাদের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। এরপর স্বাধীনতার ঘোষক ও শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সমাধির পাশে আমাদের নেত্রীকে সমাধিস্থ করা হবে, দাফন করা হবে।’

খালেদা জিয়ার জানাজায় সবাইকে শৃঙ্খলা মানার আহ্বান জানান বিএনপি মহাসচিব। তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই অত্যন্ত শৃঙ্খলার সঙ্গে এই জানাজায় অংশগ্রহণ করব। যে শৃঙ্খলার কথা বলা হবে, আমি বাংলাদেশের সব স্তরের মানুষের কাছে অনুরোধ জানাব—আপনারা সেই শৃঙ্খলা মেনে অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে জানাজা পড়বেন এবং তারপর তাকে দাফনে অংশগ্রহণ করবেন, যাদের দায়িত্ব তারাই অংশগ্রহণ করবেন। অনুরোধ থাকবে কেউ এই নিয়ম ভঙ্গ করে শুধু ছবি তোলার জন্য সামনের দিকে এগিয়ে যাবেন না। পুরো এ কর্মসূচিকে ব্যাহত করবেন না। আমরা বিশ্বাস করি, দেশনেত্রীর প্রতি আপনাদের যে সম্মান, যে শ্রদ্ধা সেটাকে অটুট রাখার জন্য আপনারা সেই শৃঙ্খলা রক্ষা করবেন এবং সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করবেন।’

ব্রিফিংয়ে সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘এরই মধ্যে সরকারের তরফ থেকে তিনদিন শোক দিবস ঘোষণা করা হয়েছে। আগামীকাল ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা বাণী দিয়েছেন, জাতির সামনে কথা বলেছেন এবং সর্বাত্মক সহযোগিতার জন্য আমরা সরকারকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সেই সঙ্গে দলের পক্ষ থেকে সাতদিনের শোক ঘোষণা করা হয়েছে। এ সাতদিন কালো পতাকা ও কালো ব্যাজ ধারণ করব। কালো পতাকা উঠবে আমাদের দলীয় কার্যালয়ে এবং প্রত্যেক কার্যালয়ে দোয়া পড়া হবে, কোরআন তেলাওয়াত হবে।’

দিনাজপুরে ইস্কান্দর মজুমদার ও তৈয়বা মজুমদার দম্পতির ঘরে ১৯৪৬ সালের ১৫ আগস্ট জন্ম নেন খালেদা জিয়া। জন্মনাম ছিল খালেদা খানম পুতুল। তিন বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয়। ১৯৬০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের দিনাজপুর শহরের ১৫ বছর বয়সী কিশোরী খালেদা খানমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ২৪ বছর বয়সী জিয়াউর রহমান। সে সময় জিয়া ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন। ডিএফআইয়ের কর্মকর্তা হিসেবে তখন দিনাজপুরে কর্মরত ছিলেন।

স্বামী জিয়াউর রহমানের সঙ্গে ১৯৬৫ সালে খালেদা জিয়া পশ্চিম পাকিস্তানে (বর্তমানে পাকিস্তান) যান। সেখানে একই বছরের ২০ নভেম্বর প্রথম পুত্র তারেক রহমানের জন্ম হয়। ১৯৬৯ সালের মার্চ পর্যন্ত স্বামীর সঙ্গে করাচিতেই ছিলেন খালেদা জিয়া। এরপর ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৭০ সালের ১২ আগস্ট দ্বিতীয় ও কনিষ্ঠ সন্তান আরাফাত রহমান কোকোর জন্ম নেয়। কিছুদিন জয়দেবপুর থাকার পর চট্টগ্রামে স্বামীর পোস্টিং হলে তার সঙ্গে সেখানে এবং চট্টগ্রামের ষোলশহর এলাকায় বসবাস করেন।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে খালেদা জিয়া কিছুদিন আত্মগোপনে থাকার পর ১৬ মে নৌপথে ঢাকায় চলে আসেন। বড় বোন খুরশিদ জাহানের বাসায় ১৭ জুন পর্যন্ত অবস্থান করেন। ২ জুলাই সিদ্ধেশ্বরীতে এস আব্দুল্লাহর বাসা থেকে পাকিস্তানি সেনারা তাকে দুই ছেলেসহ বন্দি করে। ওই বছরের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টেই বন্দি ছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে মুক্তি পান খালেদা জিয়া।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল দায়িত্ব নেন। মাত্র চার বছরের মাথায় ১৯৮১ সালের ৩০ মে নিহত হন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা এবং তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে। খালেদা জিয়া তখন নিতান্তই একজন গৃহবধূ। মূলত দুই পুত্রকে লালন-পালন ও ঘরের কাজ করেই সময় কাটাতেন। রাজনীতি নিয়ে চিন্তাধারা তো দূর, রাজনৈতিক কোনো অনুষ্ঠানেও তার দেখা মিলত না।

জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন বিচারপতি আব্দুস সাত্তার। এরপর তাকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সে সময় নানা কারণে বিএনপির নেতাকর্মীরা অনেকটা ছত্রভঙ্গ, বিপর্যস্ত এবং দিশেহারা ছিলেন। দল টিকিয়ে রাখতে জ্যেষ্ঠ নেতাদের পরামর্শ এবং অনুরোধে ১৯৮২ সালের জানুয়ারিতে রাজনীতিতে আসেন খালেদা জিয়া। সেই থেকেই শুরু। তিনি হয়ে ওঠেন বিএনপির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। স্বামীর প্রতিষ্ঠিত দলকে সংগঠিত করে সামনে এগিয়ে যেতে শুরু করেন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় হন রাজপথে।

এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় কয়েকবার আটক করা হলেও নিজের অবস্থানে অনড় ছিলেন খালেদা জিয়া। তার এ ভূমিকা দেশব্যাপী তাকে ব্যাপক জনপ্রিয় করে তোলে। এরশাদ পতনের পর ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। জীবনের প্রথম নির্বাচনেই পাঁচটি আসন থেকে লড়ে সবক’টিতেই জয়লাভ করেন বিএনপি চেয়ারপারসন। রাজনীতিতে আসার ১০ বছরের মাথায় হন সরকারপ্রধান, তাও দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী।

সেই মেয়াদ শেষে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে জয়ী হয়ে আবারো প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া। তবে বেশি দিন থাকতে পারেননি। নানা বিতর্কের কারণে একই বছরের মার্চে সে সংসদ ভেঙে দেয়া হয় এবং ১২ জুনের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এরপর ২০০১ সালের নির্বাচনে জিতে জোটসঙ্গীদের নিয়ে সরকার গঠন করে বিএনপি। প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া। মেয়াদ পূর্ণ করে ২০০৬ সালের অক্টোবরের শেষের দিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা দিয়ে সংসদ ভেঙে দেন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতেই ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর দুর্নীতির অভিযোগে পুত্র তারেক রহমানসহ আটক হন খালেদা জিয়া। এরপর ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে মুক্তিলাভ করেন। ওই বছরের ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের কাছে হেরে যায় বিএনপি। শেখ হাসিনা হলেন প্রধানমন্ত্রী, আর খালেদা জিয়া হন সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা।

নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ভোটের দাবিতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপিসহ অধিকাংশ দলই বর্জন করে। আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্রসহ ১৭টি দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। সারা দেশের ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৩টিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা বিজয়ী হওয়ায় বিতর্কের জন্ম দেয় ওই নির্বাচন।

আওয়ামী লীগ আবারো ক্ষমতায় এসে বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন চালায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, খালেদা জিয়ার প্রতি শেখ হাসিনার আচরণ রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে অনেকটাই ব্যক্তিগত আক্রোশে রূপ নিয়েছিল। এর জেরে সেনানিবাসের বাড়িছাড়া হতে হয় খালেদা জিয়াকে, বালির ট্রাকে অবরুদ্ধ থাকতে হয় বাড়িতে, শেষে কারাগারেও যেতে হয়।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। এর পরই তাকে বন্দি করে ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই জায়গাটি কারাগার হিসেবে ব্যবহারের উপযোগী ছিল না। পরিত্যক্ত ওই কারাগারে একমাত্র বন্দি হিসেবে ছিলেন তিনি। তার আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিসসহ নানা জটিল রোগ থাকা সত্ত্বেও চিকিৎসায় ঢিলেমি, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সরবরাহে অনীহা, বারবার মেডিকেল বোর্ড পরিবর্তন—এসব সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক শত্রুতারই ধারাবাহিকতা বলে মনে করা হয়।

রোগের তীব্রতা বেড়ে গেলে খালেদা জিয়াকে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (পিজি) হাসপাতালে নেয়া হয়। তবে সেখানেও ছিলেন নিরাপত্তাবলয় ও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ কভিড মহামারীর শুরুতে ২ বছর ১ মাস ১৬ দিন পর তাকে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দেয়া হয়। গুলশানে নিজের বাসভবন ফিরোজায় ফিরলেও তিনি ছিলেন মূলত গৃহবন্দি। বাইরে যাওয়া, রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ ছিল নিয়ন্ত্রিত। সভা-সমাবেশে অংশ নেয়া বা দলের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের অনুমতি ছিল না। বিএনপি ও পরিবারের পক্ষ থেকে উন্নত চিকিৎসার উদ্দেশে বিদেশে নেয়ার অনুমতি চাওয়া হয় বহুবার, কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার সাড়া দেয়নি।

ঢাকায় নিজের বাসায় থাকা অবস্থাতেই ২০২১ সালের মে মাসে করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নেন খালেদা জিয়া। তখনো শ্বাসকষ্টে ভোগার কারণে তাকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে থেকে চিকিৎসা নিতে হয়েছিল। এরপর ২০২৪ সালের জুনে হৃৎপিণ্ডে পেসমেকার বসানো হয়। তখনো তিনি মূলত হার্ট, কিডনি ও লিভারসহ বিভিন্ন ধরনের রোগে ভুগছিলেন; যা তার শারীরিক অবস্থাকে জটিল করে তুলেছিল। এর আগে থেকেই তার হার্টে তিনটি ব্লক ছিল। আগে একটা রিংও পরানো হয়েছিল। এছাড়া ২০২৪ সালের জুনে পোর্টো সিস্টেমেটিক অ্যানেসটোমেসির মাধ্যমে খালেদা জিয়ার লিভারের চিকিৎসাও দেয়া হয়েছে বিদেশ থেকে ডাক্তার এনে।

২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর খালেদা জিয়া মুক্তি পান। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে বিদেশ নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কাতারের আমিরের পাঠানো বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে তিনি গত জানুয়ারিতে লন্ডন যান। অনেকটা সুস্থ হয়ে ফিরে এলেও ঢাকায় আরো কয়েকবার হাসপাতালে যেতে হয়েছে বেগম জিয়াকে। ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দেন। বাসায় ফেরার পর তিনি আরো অসুস্থ হয়ে যান এবং তার শ্বাসকষ্ট তীব্র হয়ে ওঠে বলে জানা যায়। এ অবস্থায় গত ২৩ নভেম্বর বিএনপি চেয়ারপারসনকে জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে নেয়ার পর জানা যায় তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। পরে ফুসফুস ও হৃদযন্ত্রের গুরুতর সংক্রমণ নিয়ে সংকটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। এর পর থেকে বিভিন্ন সময় তার শারীরিক অবস্থা অপরিবর্তিত হয়। এরই মধ্যে উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেয়ার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে বারবার। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়, মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শ ছাড়া এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হবে না। তাই বারবারই পিছিয়ে যায় তার বিদেশযাত্রা।

 


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ রকম আরো সংবাদ...
https://slotbet.online/