• শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৫, ১১:১৮ অপরাহ্ন

পায়রার তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে দৈনিক ক্ষতি ৫ কোটি টাকা

দর্পন ডেস্ক / ১৬ পড়া হয়েছে
প্রকাশিত : সোমবার, ২০ অক্টোবর, ২০২৫

দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে নতুন সংযোজন হিসেবে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার পায়রা নদীর তীরে প্রস্তুত করা হয়েছে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক আরেকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। অবকাঠামোগত সব কাজ শেষ হলেও পর্যাপ্ত কয়লা সরবরাহ ও সঞ্চালন লাইনের জটিলতার কারণে দফায় দফায় পিছিয়ে যাচ্ছে কেন্দ্রটির বাণিজ্যিক উৎপাদন (সিওডি) শুরুর তারিখ। এদিকে কেন্দ্রটি সচল রাখার জন্য পরিচালন ব্যয়, বিদেশী ও স্থানীয় পরামর্শক ফি, রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত, প্রশাসনিক খাতসহ বিভিন্ন ব্যয়ে প্রতি মাসে গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত ১২ মিলিয়ন ডলার বা বাংলাদেশী মুদ্রায় ১৪৬ কোটি ১৬ লাখ টাকার বেশি। দৈনিক হিসাবে যার পরিমাণ দাঁড়ায় কমপক্ষে ৫ কোটি টাকা।

আর্থিক এ ক্ষতির বিষয়টি মূল্যায়ন করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (বিপিডিবি) এরই মধ্যে চিঠি দিয়েছে কেন্দ্রটির পরিচালনা প্রতিষ্ঠান আরপিসিএল-নরিনকো পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি লিমিটেড (আরএনপিএল)।

বিপিডিবিকে পাঠানো চিঠিতে জানানো হয়, আরএনপিএলের বাণিজ্যিক উৎপাদন বিলম্বিত হওয়ায় কেন্দ্রটির অতিরিক্ত ব্যয় যুক্ত হবে প্রকল্পের মোট নির্মাণ ব্যয়ের সঙ্গে। এতে সামগ্রিক প্রকল্প ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাবে, যা শেষ পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন ট্যারিফে সরাসরি প্রভাব ফেলবে। আর ব্যয় বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে আরএনপিএলের উৎপাদিত বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি খরচ পড়বে অন্যান্য কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রের তুলনায় অনেক বেশি। এর ফলে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহকৃত বিদ্যুতের গড় মূল্যও বৃদ্ধি পেতে পারে, যা এ খাতে সামগ্রিক ব্যয়চাপ বাড়াবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আরএনপিএলের কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট গত ১ মার্চ পরীক্ষামূলক উৎপাদনে যায়। সেই থেকে সীমিত পরিসরে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে যাচ্ছে। দ্বিতীয় ইউনিটটি পুরোপুরি বসিয়ে রাখা হয়েছে। গ্রিডে বর্তমানে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে তা কেন্দ্রটির পুরো সক্ষমতার মাত্র ২৫ শতাংশ (প্লান্ট ফ্যাক্টর বিবেচনায়) বলে জানান প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

আরএনপিএলের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাণিজ্যিক উৎপাদনের বিষয়ে জানতে চাইলে বিপিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী রেজাউল করিম বলেন, আরএনপিএল কর্তৃপক্ষ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির বাণিজ্যিক উৎপাদনের বিষয়টি আমাদের জানিয়েছে। আমরা পিজিসিবি (পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড) থেকে একটি ইউনিটের বিষয়ে ক্লিয়ারেন্স পেয়েছি। বাকি ইউনিট ইভাক্যুয়েশন লাইনের ওপর নির্ভর করছে। পিজিসিবি কবে এ লাইন সম্পন্ন করবে, সে বিষয়ে আমরা কোনো তথ্য পাইনি। ফলে কেন্দ্রটির একটা ইউনিটের বিদ্যুৎ আমাদের দ্রুত নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।’

বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি সিওডি হলে তার জন্য যে পরিমাণ কয়লার দরকার, তার পর্যাপ্ত সংস্থান আছে কিনা জানতে চাইলে বিপিডিবির চেয়ারম্যান বলেন, ‘কয়লার বিষয়টি আমরা বলতে পারব না। কারণ সেটি তারা (আরএনপিএল) নিজেরাই কেনে। এখন তারা কয়লার ব্যবস্থা করে বিদ্যুৎ দিতে পারলে বিপিডিবি তা কিনবে। যদি না পারে তাহলে কিনবে না।’

আরএনপিএল সূত্রে জানা গেছে, কলাপাড়ায় স্থাপিত আরএনপিএলের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণে মোট ব্যয় হচ্ছে ২ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার। এতে অর্থায়ন করেছে চীনের এক্সিম ব্যাংক। তবে নির্ধারিত সময়ে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে না পারায় দাতা সংস্থা অর্থায়ন স্থগিত রাখবে বলে আরপিসিএলের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এরই মধ্যে এ প্রকল্পে বিশেষজ্ঞদের বসিয়ে রাখাসহ বিভিন্ন খাতে আর্থিক ক্ষতির কথা জানিয়েছে ইপিসি (ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকিউরমেন্ট কনস্ট্রাকশন) ঠিকাদারও।

আরএনপিএলের ১৪ বছর মেয়াদি এ ঋণচুক্তির মধ্যে চার বছর গ্রেস পিরিয়ড। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে এ ঋণচুক্তি হয়। সে হিসাবে গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়েছে ২৭ সেপ্টেম্বর। চুক্তির শর্তে বলা হয়, প্রকল্প শেষ হওয়ার ছয় মাস পর থেকে ঋণ পরিশোধ শুরু হবে। তাই ঋণের প্রথম কিস্তি পরিশোধ করতে হবে আগামী বছরের মার্চের মধ্যে।

চীনা ব্যাংকের ঋণের কিস্তি পরিশোধ ও কেন্দ্রটির দ্রুত বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য গত আগস্টেও বিপিডিবিকে চিঠি দিয়েছে আরএনপিএল। যদিও সিওডির বিষয়টি নিয়ে বিপিডিবির পক্ষ থেকে কোনো ধরনের উত্তর না পাওয়ার কথা জানিয়েছেন আরএনপিএলের কর্মকর্তারা।

এদিকে কেন্দ্রটির বাণিজ্যিক উৎপাদন বার বার পিছিয়ে যাওয়ায় চীনের এক্সিম ব্যাংক এরই মধ্যে এক চিঠি দিয়ে আরএনপিএলকে প্রকল্প ঋণের ৫৩ মিলিয়ন ডলার সুদ পরিশোধ করতে বলেছে। যদিও এ অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে কিনা জানা যায়নি।

নির্ভরযোগ্য বেশ কয়েকটি সূত্রে জানা গেছে, পায়রায় আরএনপিএলের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালানোর ক্ষেত্রে সঞ্চালন লাইন সংকটের বিষয়টি বার বার সামনে আনা হলেও মূল সংকটটি কয়লার সরবরাহ নিয়ে। আড়াই বছরের বেশি সময় পার হলেও এখনো কেন্দ্রটির জন্য নির্ভরযোগ্য কোনো কয়লা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত করতে পারেনি সরকার। চতুর্থ দফায় সিঙ্গাপুরভিত্তিক কোম্পানি ইয়াংথাই এনার্জি পিটিই লিমিটেড কারিগরি ও আর্থিকভাবে নির্বাচিত হলেও শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ দেয়া হয়নি। পরবর্তী সময়ে পঞ্চম দফায় নতুন করে কয়লা আমদানির দরপত্র আহ্বানের উদ্যোগ নেয় আরএনপিএল কর্তৃপক্ষ। তবে সে প্রক্রিয়া এখন আদালতে বিচারাধীন থাকায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিদ্যুৎ বিভাগের দুজন কর্মকর্তা বলেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালাতে হলে পর্যাপ্ত কয়লা প্রয়োজন। এজন্য দরকার দীর্ঘমেয়াদের সরবরাহকারী। আড়াই বছর ধরে কয়লার টেন্ডারের কার্যক্রম চলছে। কিন্তু কাউকে কাজ দেয়া যায়নি। নতুন করে কয়লার টেন্ডার আহ্বান করে এ ধরনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হলে অন্তত চার-পাঁচ মাস সময় প্রয়োজন। কারণ এখানে টেন্ডার আহ্বানের সময়সীমা, কারিগরি মূল্যায়ন, আর্থিক মূল্যায়নসহ নানা প্রক্রিয়া রয়েছে।

এদিকে টেন্ডার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত না করে আরএনপিএলের বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাণিজ্যিক উৎপাদনে গেলে অর্ধেক মাসও চালানো যাবে না বলে প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। কেননা কেন্দ্রটি চালাতে বছরে অন্তত চার মিলিয়ন টন কয়লার প্রয়োজন। দৈনিক হিসাবে ১২ হাজার টন। তবে বর্তমানে যে পরিমাণ কয়লা মজুদ রয়েছে তা দিয়ে পূর্ণ সক্ষমতায় কেন্দ্রটি চালানো যাবে মাত্র ১৭ দিন।

সেই হিসাবে আগামী পাঁচ মাস যদি কেন্দ্রটির বাণিজ্যিক উৎপাদন থমকে থাকে তাহলে প্রায় ৭৫০ কোটি টাকার মতো আর্থিক লোকসান হবে আরএনপিএলের। অন্যদিকে বিদ্যমান দরপত্র প্রক্রিয়ার আওতায় যদি নির্বাচিত কোম্পানিকে কাজ দেয়া যায়, সে ক্ষেত্রে এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা আমদানির কাজ শুরুর সুযোগ রয়েছে বলে বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।

আরএনপিএলের বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা আমদানির জন্য ২০২২ সালের নভেম্বরে ডাকা হয় প্রথমবার দরপত্র। ওই দরপত্রে সাতটি প্রতিষ্ঠানের ছোট একটি তালিকাও করা হয়। তবে দরপত্রে বেশকিছু শর্তের পরিবর্তনের কারণে পরে তা বাতিল করা হয়। এর পর গত বছরের ১৫ জানুয়ারি দ্বিতীয় দফায় দরপত্র আহ্বান করা হয়। ওই দরপত্রে পাঁচটি কোম্পানি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দাখিল করে। ওই দরপত্রে সিঙ্গাপুরভিত্তিক ইয়াংথাই এনার্জি কারিগরিভাবে যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু ওই বছরের ৫ আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দরপত্রটি পরে বাতিল করে দেয়া হয়।

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর আরএনপিএলের বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা আমদানির জন্য ৬ নভেম্বর তৃতীয় দফায় দরপত্র আহ্বান করে। পরে সেটিও বাতিল করা হয়। চতুর্থ দফায় দরপত্রে কারিগরি ও আর্থিকভাবে সিঙ্গাপুরভিত্তিক ইয়াংথাই এনার্জি পুনরায় নির্বাচিত হলেও তা বাতিল করে নতুন দরপত্র আহ্বানের সিদ্ধান্ত নেয় আরএনপিএল। যদিও চতুর্থ দফায় ডাকা দরপত্রের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের বিষয়টি এখন আদালতের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে।

আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে প্রথম সংযুক্ত করা হয় চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি, আর দ্বিতীয় ইউনিট ৯ এপ্রিল। এর পর থেকে বিপিডিবি কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট থেকে পরীক্ষামূলকভাবে সীমিত পরিসরে বিদ্যুৎ নিচ্ছে। তবে কেন্দ্রটির পুরো সক্ষমতা কবে নাগাদ ব্যবহার হবে সে বিষয়ে জানতে চাইলে আরএনপিএলের কোনো কর্মকর্তা মন্তব্য করতে রাজি হননি।

যদিও আরএনপিএলের আর্থিক ক্ষতির সম্ভাব্য সমীক্ষার বিষয়টি জানিয়ে বিপিডিবিকে সম্প্রতি চিঠি দেন আরএনপিএলের পরিচালক ও আরপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ড. নাজমুস সায়াদাত। চিঠির বিষয়ে জানতে বণিক বার্তার পক্ষ থেকে গতকাল মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও নাজমুস সায়াদাত সাড়া দেননি।

 


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ রকম আরো সংবাদ...
https://slotbet.online/