বরিশাল বিভাগের সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। ৫০০ শয্যা নিয়ে ১৯৬৮ সালে যাত্রা শুরু করে হাসপাতালটি। ২০০৬ সালে ১০০০ শয্যায় উন্নীত হলেও এখনো তা চলছে আগের জনবল কাঠামোতেই। পুরনো জনবল কাঠামোর অনুকূলে যে চিকিৎসক থাকার কথা, তার অর্ধেকের কম চিকিৎসক দিয়ে চলছে স্বাস্থ্যসেবা। কভিডের সময় ৫০০ শয্যার নতুন আরো একটি ভবন নির্মাণ করা হয়। কভিড সংক্রমণ কমে গেলে বর্ধিত শয্যাগুলোও হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। সব মিলিয়ে ১৫০০ শয্যার হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে চিকিৎসা নিচ্ছে প্রায় তিন হাজার রোগী। বিপুলসংখ্যক রোগী সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও সেবিকারা।
তারা বলছেন, চিকিৎসক, নার্স সংকটে বেহাল এখানকার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা। ধারণক্ষমতা সীমিত হলেও রোগীর চাপ বাড়ছে। ফলে প্রতিটি রোগী যে সেবা পাওয়ার কথা তার এক-তৃতীয়াংশও পাচ্ছে না। মেঝেতে রোগী ভর্তি থাকায় হাসপাতাল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোগীর সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, প্রথম শ্রেণীর চিকিৎসকের মঞ্জুরীকৃত পদ রয়েছে ৩২৩টি। তবে কর্মরত রয়েছেন ২৩১ জন। অন্যান্য কর্মকর্তার ১৫টি পদ থাকলেও কর্মরত আছেন চারজন। দ্বিতীয় শ্রেণীর সিনিয়র স্টাফ নার্সের পদ রয়েছে ১০০৭টি। সেখানে কর্মরত আছেন ৯৫২ জন। তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীর পদ রয়েছে ১৬৩টি। তবে কর্মরত আছেন ৯২ জন। চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী থাকার কথা ৪৩৩ জন। সেখানে কর্মরত আছেন ২২৩ জন। হাসপাতালের ১৫টি ওয়ার্ডের ৩১টি ইউনিটে গড়ে রোগী ভর্তি রয়েছে ২ হাজার ২৮৮ জনের বেশি।
বরিশাল সদর উপজেলার চরবাড়িয়া থেকে বোনকে নিয়ে হাসপাতালে মেডিসিন ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিতে আসেন সুফিয়ান। তিনি বলেন, ‘আমার বোন তিনদিন এখানে ভর্তি রয়েছে। বেড পাইনি। মেঝেতে সিট বিছিয়ে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। তার মধ্যে চিকিৎসকেরও দেখা পাওয়া ভার। যারা আসছেন, সবাই ইন্টার্ন চিকিৎসক।’
গতকাল দুপুরে হাসপাতালের লেবার (প্রসূতি) ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে, বেড না পেয়ে অনেকে বারান্দায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। একই অবস্থা মেডিসিন ওয়ার্ডের মেঝে, বারান্দা ও সিঁড়ির চিলেকোঠায়। রোগী ও তাদের স্বজনে ঠাসা পুরো হাসপাতাল।
রোগীর স্বজন কাজী বেল্লাল হোসেন বলেন, ‘নতুন হাসপাতাল ভবন না হলে এ দুর্ভোগ লাঘবের কোনো উপায় নেই। সরকার বিষয়টিতে নজরে না দিলে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা মানুষের দুর্ভোগের শেষ হবে না।’
চিকিৎসকরা বলছেন, অতিরিক্ত রোগীর জন্য প্রতিদিন তিন গুণ স্যালাইন, সিরিঞ্জ, ওষুধের প্রয়োজন হয়। এতে তিনদিনের সাপ্লাই একদিনেই শেষ হয়ে যায়। একইভাবে নার্স সংকটও প্রকট। যা থাকা উচিত তার এক-তৃতীয়াংশও নেই। হাসপাতালের অধিকাংশ বিষয়ে তাদের কোনো কর্তৃত্ব নেই। তারা চিকিৎসা পরামর্শ দিলেও প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতার কারণে কাঙ্ক্ষিত সেবা নিশ্চিত করতে পারছেন না।
নাক কান গলার সার্জন ডা. শরিফুল ইসলাম রুমেন বলেন, আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি রোগীর সেবা নিশ্চিত করতে। তবে হাসপাতালে শয্যা না বাড়ালে রোগীর দুর্ভোগ লাঘব সম্ভব নয়। বিষয়টিতে কর্তৃপক্ষের নজর দিতে হবে। ১০ বছর আগেও হাসপাতালে রোগীর এমন চাপ ছিল না। এখন এত রোগী আসছে, তার পরও সেবাবঞ্চিতের কোনো অভিযোগ নেই। একটাই অভিযোগ শয্যা নেই। মেঝে ও বারান্দায় থাকতে হচ্ছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রত্যেক রোগীর বিছানা পাওয়ার অধিকার আছে। বিছানা ছাড়া চিকিৎসা দেয়া, মেঝেতে রাখা আর রাস্তায় রাখা একই কথা। প্রতি ১০০ রোগীর জন্য বেড থাকবে ২৫-৩০টি। স্বাভাবিকভাবেই এক বেডে তিন-চারজন রোগী ভাগ হয়ে যায়, বাকিরা মেঝেতেও জায়গা পায় না।
সার্বিক বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম মশিউল মুনীর বলেন, হাসপাতালে সেবার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে এরই মধ্যে বেশকিছু কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। আগামী তিন মাসের মধ্যে আরো কিছু কাজ শেষ হবে। কিডনি ডায়ালাইসিস মেশিন ১০টি থেকে বাড়িয়ে ২০টি করা হয়েছে। এর মধ্যে দুটি মেশিনে সি-ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের ডায়ালাইসিস করা হয়। আরো পাঁচটি মেশিন ক্রয় করা হবে। আউটডোর ও ইনডোরের প্রায় সব রোগীর প্যাথলজি ও রেডিওলজি পরীক্ষা হাসপাতালেই করা হচ্ছে। সিটি স্ক্যান মেশিন পুনরায় চালু করা হয়েছে। হাসপাতালে ৯৫টি অকেজো মেশিন সচল করেছে। আরো ২০টি মেশিন সচলের কার্যক্রম চলছে। একাডেমিক কাউন্সিলের বর্ধিত সভায় রোগীদের অসন্তোষের মূল জায়গা মেডিসিন বিভাগও মূল ভবনে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে ভবনের নিচতলায় মেডিসিন, সার্জারি ও গাইনি বহির্বিভাগ স্থানান্তর করে চালু করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে ওই ভবনে বহির্বিভাগ স্থানান্তর করে চালু করা হবে। ফলে পুরনো ভবনটি পুরোপরি ইনডোর ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হবে। রোগীদের সুবিধার্থে নতুন আউটডোর ভবনে টিকিট কাউন্টার ও ডিসপেনসারি চালু করা হয়েছে।’
https://slotbet.online/