পটুয়াখালীর মহিপুরে শিববাড়ীয়া নদী থেকে উৎপওি গাববাড়ীয়া সোনাতলা সংযোগ নদীতে বাঁধ নিমার্নের বিরূপ প্রভাবে দক্ষিণাঞ্চলের বিস্তীর্ণ জনপদের প্রাণ-প্রকৃতি, জনজীবন বিপর্যস্থ হয়ে পড়েছে। পানির অভাবে মারা গেছে অনেক নদ। এখনো শতাধিক নদ-নদীর মরণ দশা। গাববাড়ীয়া নদীর এবাঁধ নদীটিকে হত্যা করার শামিল। এ বাঁধটি এখন অত্র এলাকার ৪০ গ্রামবাসীর মরন ফাঁদে পরিনত হয়েছে।
১০কিলোমিটার পথ খাল-দূষণসহ বাঁধ ও সুইজগেটের কারণে নদীগুলো নাব্য হারিয়েছে। ফলে নদী দিয়ে পানি নিষ্কাষিত না হওয়ায় বছরে ভারী বৃষ্টিতে ডালবুগঞ্জ, ধুলাসার, মিঠাগঞ্জ, মহিপুর, বালীয়াতলী ইউনিয়নের অন্তত ৪০ গ্রাম তলিয়ে যায়। অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়েন হাজার হাজার মানুষ।
একসময় নদী-খাল-বিলে পর্যাপ্ত পানি থাকায় চাষিরা সেউচির (অযান্ত্রিক পদ্ধতি) মাধ্যমে জমিতে সেচ দিত। কিন্তু যন্ত্রনির্ভর এই সেচব্যবস্থা ব্যাপক ব্যয় বহুলও। এর ফলে বেড়েছে কৃষি উৎপাদনের খরচ, বেড়েছে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের দামও। এ ছাড়া দেশের সভ্যতা, শহর-নগর-বাণিজ্যকেন্দ্র গুলো গড়ে উঠেছে নদী তীরবর্তী স্থানে। হাজার বছর ধরে এসব জনপদে যাতায়াত ও বাণিজ্যের প্রধান পথ ছিল নদী। কিন্তু পানির অভাবে নদ-নদী শুকিয়ে যাওয়ায় এখন নৌযোগাযোগ মূলত নৌযান আসতে পারে না।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নদীতে বাঁধ নির্মান করায় তিন দিকের তিনটি শাখা ও সংযোগ নদীতে পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। বেরিবাঁধের ভেতরের খালের পানি নামার ১৯টি সুইজগেটের প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। এসব সুইজগেট থেকে পানি শুধু ভেতরের খালে ওঠে। কিন্তু নামে না। যা ওই বাঁধটি কৃষকের কোনো উপকারে আসছে না। ফলে অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মানে অর্ধলাখ কৃষকের অন্তত ৭৫ হাজার একর কৃষি জমিতে এবং অন্তত ৪০ গ্রামের ভয়াবহ জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে।
সম্প্রতি দেখা গেছে, বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই এমন জলাবদ্ধতায় হাজার হাজার কৃষক পড়েছেন চরম বিপাকে। কোমর থেকে হাঁটু সমান পানি জমে যাওয়ায় সব পানি দুষিত হয়ে যাচ্ছে। সোনাতলা নদী থেকে ওঠা সংযোগ নদীর গাববাড়ীয়া পয়েন্টে বাঁধ দেয়ার ফলে চারটি ইউনিয়নের এক-তৃতীয়াংশ কৃষি জমিতে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। প্রায় ৭৫ হাজার কৃষক চরম স্থায়ী ক্ষতির কবলে পড়েছেন। আর আমন আবাদ নিয়ে তারা মৌসুমের শুরুতে পড়েছেন অনিশ্চয়তায়। এমন অপরিকল্পিত বাঁধ এখন কৃষকের মরন ফাঁদে পরিনত হয়েছে। কৃষকেরা আমনের বীজতলা করতে পারছেন না। গাববাড়ীয়ার নদীতে বাঁধ দেয়ায় পক্ষিয়াপাড়া নদীতে পানি চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। পানি নামার আরামগঞ্জ,সাতভাইয়া , নয়াকাটা, ডালবুগঞ্জ সুইজগেট এখন আর কোনো কাজে আসছেনা। জোয়ার সময় পানি ওঠে কিন্তু ভাটায় নামে না। আর পানি ওঠানামা বন্ধ থাকায় পচে পানি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। গরু -মহিষ নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন তারা। আমন বীজতলা তৈরি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। ওই বাঁধ দেয়ায় চারটি শাখা নদীর পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। ভাটার সময় সাপুড়িয়া দিয়ে পানি নামতে নামতে আবার নদীতে জোয়ার এসে যায়। গাববাড়ীয় নদীর পশ্চিম দিকের মুলাম খালের সুইজগেটে জোয়ার ভাটার না থাকায় আস্তে আস্তে খালটি ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ফলে সংযোগ নদীতে পানি নামানোর জন্য ব্যবহৃত ১৯টি সুইজগেট অকোজে হয়ে গেছে, পানির প্রবাহ নেই। ভেতরের পানি নামানোর একমাত্র অবলম্বন সুইজগেট। তা এখন কাজে আসছে না। বেরিবাঁধের ভেতরের পানি শাখা নদী হয়ে বড় নদীতে যাচ্ছে না। এমনকি পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শাখা ও সংযোগ নদীগুলোর দুই পাড়ের মাইলের পর মাইল ছইলা- কেওড়ারসহ সংরক্ষিত বাগানের গাছসহ পরিবেশ নষ্ট হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ওই নদীতে বাঁধের আগে নৌকায় ভাসানিরা বাজারে যেত, সাপ্তাহিক বাজারে বিভিন্ন জিনিসপত্র বিক্রির জন্য। লঞ্চ, নৌকা, ট্রলার দিয়ে বিভিন্ন ধরনের মালামাল আনা নেয়া করতো। কিন্তু গাববাড়ীয়া নদীতে বাঁধ দেয়ায় সব কিছু বন্ধ হয়ে গেছে। পলি পড়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শাখা খাল গুলো। অধিকাংশ শাখা নদী-খাল পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে। একারনে প্রতি বছর পানি জমে ক্ষতি হয় কোটি কোটি টাকার সম্পাদ। এ এলাকার সুইজগেট গুলো পলি জমে মাটির নিচে দেবে যাচ্ছে। পাউবো কর্তৃপক্ষ ওই সব সম্পাদ রক্ষায় কোন উদ্যোগ নেয়নি। বর্তমানে নদীগুলো পলি পড়ে ভরাট হয়ে ভুমিতে পরিনত হয়েছে। ফলে এলাকায় দেখা দিয়েছে স্থাযী জলাবদ্ধতা। এতে বিস্তীর্ন এলাকায় আবাদি জমি পানির নিচে তলিয়ে থাকে। ঐতিহ্যবাহী সোনাতলা নদী কয়েক বছরের ব্যবধানে পলি জমে নদীটি ভরাটহয়ে যাওয়ায় উপক্রম হয়েছে। যে কারনে বন্ধ হয়ে গেছে নৌযান চলাচল। আর এর প্রভাব পড়েছে ব্যবসা বানিজ্য থেকে শুরু করে এলাকার অর্থ-সামাজিক অবস্থার।কলাপাড়া উপজেলা শহরে যাতাযাতের অন্যতম ও ব্যবসা বানিজ্যের সব পন্য আনা নেয়ার অন্যতম মাধ্যম ও ছিল নদীটি। জেলে সম্প্রদায়সহ শত শত নিম্ন আয়ের মানুষ নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। ওই পয়েন্টে বাঁধ দেয়ার সময় সাবেক ডালবুগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আ.সালাম সিকদারসহ হাজার হাজার কৃষক নিয়ে মানববন্ধন করেছেন। করেছেন প্রতিবাদ সমাবেশ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পানি উন্ন্য়ন র্বোড কোনো কথা আমলে নেয়নি। ওই পয়েন্টে একটি গার্ডার ব্রিজ নির্মান করার উদ্যাগ নেয়া হয়। এ জন্য সাইটে মালামাল পর্যন্ত নেয়া হয়। কাজের আনুষ্টানিক উদ্বোধন ও করা হয়। পরে রহস্যজনক ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এই গার্ডার ব্রিজ নির্মান করলে ব্যয়ও কম হতো অথচ নির্মান করা হয়েছে (ক্লোজার) বাঁধ। কৃষকসহ সকল মানুষের বক্তব্য এটা পানি উন্নয়ন র্বোড কোনো ধরনের পরিকল্পনা ছাড়াই নিজেদের এবং ঠিকাদারের স্বার্থে বাঁধ নির্মান করায় তিনটি শাখা নদী ও সংযোগ নদীর পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু কালের বিবর্তনে আজ নদীটি মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। এখন দরকার ছয় গেটের একটি স্লুইজ।
ধুলাসার ইউনিয়নের তারিকাটা গ্রামের কৃষক হোসেন জানান, গাববাড়ীয়া নদীতে বাঁধ দেয়ার কারনে আমাদের এলাকার নদী গুলোর পানির প্রবাহ কমে গেছে। তাছাড়া বাবলাতলা খালে ওক্কাচোরা পয়েন্টে বাঁধ দিয়ে ছোট ছোট পুকুর তৈরি করা হয়েছে। আবার স্থানীয় প্রভাবশালীরা নদের মুখে জাল পেতে কৃত্রিম জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করেছে। এখন বীজ ধান ফালাবো কিন্তু ধান ফালাতে পারতেছিনা পানির কারনে।
ডালবুগঞ্জ ইউনিয়নের মনসাতলী গ্রামের কৃষক ইশারাত আলী বলেন, গাববাড়ীয়া নদী আর নদী নেই, শ্মশান হয়ে গেছে। বাঁধ নির্মানে করার জন্য নদীর মধ্যে ভরাট করা হয়েছে। এতে নদী শেষ।আমরা এখন এখানে জরুরী একটি সুইজগেট চাই।
পরিবেশবাদী ও নদী রক্ষা আন্দোলনের কর্মী, সিনিয়র সাংবাদিক মেজবা উদ্দিন মান্নু বলছেন, বাঁধ নির্মাণের জন্য এভাবে বাঁধ দেওয়া নদী হত্যার শামিল। বাঁধ দেওয়া হলে নিচে ভরাট হওয়ার কারণে নদীতে পানি প্রবাহ কমে গেছে। এ কারনে নদীর পাড়সহ নদী গুলো ভরাট হতে চলছে।এখানে এখন বড় একটি সুইজগেট জরুরী প্রয়োজন।
কৃষিবিদদের মতে, ফসলের মাঠে ভূউপরিস্থ পানি ব্যবহার করলে জমির স্বাস্থ্য ভালো থাকে। ভূগর্ভস্থ পানি জমির উর্বরতা কমায়। ফলে ভালো ফসল উৎপাদন করতে কৃষককে এখন সারসহ নানা খাতে বিপুল টাকা খরচ করতে হচ্ছে। পরিবেশের বাস্তুসংস্থান নষ্ট হওয়ায় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুজীব থেকে শুরু করে বহু প্রাণীর অস্তিত্ব হয় বিলুপ্ত হয়েছে, অথবা বিলুপ্তি সংকটে পড়েছে। হারিয়ে গেছে প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল হরেক পেশা। হাজারো রকমের স্বাদু পানির মাছের জন্য বিখ্যাত অঞ্চলটিতে এখন দেশি মাছ নেই বললেই চলে।
এ ব্যাপারে কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা(ভারপ্রাপ্ত) মো,ইয়াসিন ছাদেক বলেন, গাববাড়ীয়া নদীতে বাঁধ দেয়া এলাকায় যে সমস্যা হয়েছে, এ ব্যাপারে উর্ধ্বতন কতৃপক্ষের সাথে আলাপ করে প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নেয়া হবে।
এ রকম আরো সংবাদ...