• শনিবার, ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ০১:৫১ পূর্বাহ্ন

ট্রমায় জর্জরিত গাজার শিশুরা

দর্পন ডেস্ক / ১২ পড়া হয়েছে
প্রকাশিত : সোমবার, ২০ অক্টোবর, ২০২৫

গাজায় যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসার পর আমার মনে নানা ধরনের অনুভূতি ভর করেছিল। একদিকে আনন্দ অবশেষে বোমা বর্ষণ থেমেছে, অন্যদিকে ভয় যেকোনো সময় আবার শুরু হতে পারে। একদিকে আশাবাদ হয়তো এখন স্বাভাবিক জীবনে ফেরা যাবে, আবার অন্যদিকে উদ্বেগ এই স্বাভাবিকতা হয়তো বেশিদিন স্থায়ী হবে না।

একজন ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে আমার একটাই আশা, যত দ্রুত সম্ভব গাজায় শিক্ষাব্যবস্থা পুনরায় চালু হোক। কারণ শিক্ষাই একমাত্র উপায়, যা আশা ফিরিয়ে আনতে পারে, শিশুদের দুই বছরের গণহত্যার ট্রমা থেকে ধীরে ধীরে মুক্তি দিতে পারে। এটি তাদের জীবনে স্বাভাবিকতার ছোঁয়া ও লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিতে পারে। তাই গাজায় শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠন হওয়া উচিত সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের বিষয়।

গণহত্যা শুরুর আগে আমি গাজা সিটির এক সরকারি মেয়েদের স্কুল ও একটি শিক্ষাকেন্দ্রে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের ইংরেজি পড়াতাম। যুদ্ধের প্রথম কয়েক সপ্তাহেই স্কুলটি ধ্বংস হয়ে যায়; শিক্ষাকেন্দ্রটিও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

আমার পরিবার ও আমাকে ঘর ছেড়ে পালাতে হয়। কয়েক মাস পর আমি এক তাঁবুতে পড়ানো শুরু করি, স্থানীয় কিছু স্বেচ্ছাসেবীর উদ্যোগে চালু হওয়া একটি ছোট শিক্ষা প্রকল্পে। তাঁবুতে কোনো বেঞ্চ ছিল না; ছয় থেকে বারো বছর বয়সী শিশুরা মাটিতে বসেই পড়ত। পড়ানোর পরিবেশ ছিল কঠিন, কিন্তু আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম, যত কষ্টই হোক, শিশুদের শেখার ধারাবাহিকতা যেন বন্ধ না হয়।

২০২৪ সালের ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ বাজার থেকে কলম, বই, খাতা পুরোপুরি উধাও হয়ে যায়। একটি খাতার দাম দাঁড়ায় ২০ থেকে ৩০ শেকেল (৬ থেকে ৯ ডলার), যা বেশিরভাগ পরিবারের নাগালের বাইরে।

কাগজ, বই ও কলমের এমন অভাব দেখা দিলে কিছু শিক্ষার্থী খালি হাতে ক্লাসে আসত; কেউ ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করা ছেঁড়া কাগজ নিয়ে আসত; আবার কেউ পুরনো ব্যবহৃত কাগজের পেছনে ক্ষুদ্র অক্ষরে লিখত। কলম এতটাই অপ্রতুল ছিল যে, অনেক সময় একাধিক শিক্ষার্থীকে একটি কলম ভাগ করে নিতে হতো।

লেখা ও পড়া যখন এতটা কঠিন হয়ে উঠল, তখন আমরা শিক্ষকরা বিকল্প উপায়ে পাঠদান শুরু করলাম— গান, গল্প বলা, দলগত মুখস্থ পাঠ ইত্যাদির মাধ্যমে।

সব অভাব-অনটনের মাঝেও শিশুদের শেখার ইচ্ছাশক্তি ছিল বিস্ময়কর। ওদের পুরনো কাগজের টুকরোয় লেখার দৃশ্য আমাকে একইসাথে গর্বিত ও ব্যথিত করত, ওদের অদম্য ইচ্ছা ও অধ্যবসায়ই আমাকে অনুপ্রাণিত করত।

আমার নিজের একটি বিশেষ খাতা ছিল, যেটি আমার দাদি আমাকে বহু বছর আগে উপহার দিয়েছিলেন। আমি তাতে আমার স্বপ্ন ও গোপন কথা লিখতাম। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হলে সেই খাতার পাতাগুলো ভরে উঠল বিস্ফোরণের গল্পে, রাস্তার ধারে ঘুমানো গৃহহীন মানুষের বেদনায়, আগে কখনো না দেখা দুর্ভিক্ষ ও বঞ্চনার কাহিনিতে।

আগস্টের একদিন, যখন দেখলাম আমার বেশির ভাগ শিক্ষার্থী কাগজবিহীন ক্লাসে এসেছে, তখন বুঝলাম আমাকে কী করতে হবে। আমি আমার সেই খাতাটি বের করলাম, আর পাতাগুলো একে একে ছিঁড়ে ওদের হাতে দিলাম।

শিক্ষার্থীর সংখ্যা এত বেশি ছিল যে, একদিনেই খাতার সব পাতা শেষ হয়ে গেল। তারপর ওরা আবার কাগজের টুকরো ও কার্ডবোর্ডে লেখা শুরু করল।

যুদ্ধবিরতি বোমা হামলা থামিয়েছে বটে, কিন্তু আমার শিক্ষার্থীরা এখনো কাগজ-কলমবিহীন। মানবিক সহায়তা আবার গাজায় ঢুকতে শুরু করেছে, খাদ্য, ওষুধ, আশ্রয়ের উপকরণ আসছে। এগুলো অবশ্যই জরুরি। কিন্তু একইসাথে আমাদের শিক্ষাসামগ্রী ও শিক্ষা সহায়তাও প্রয়োজন, যাতে গাজার ছয় লাখ স্কুল পড়ুয়া শিশুর জন্য শিক্ষাব্যবস্থা আবার চালু করা যায়।

বই, খাতা, কলম— এগুলো শুধু শিক্ষাসামগ্রী নয়; এগুলো জীবনরেখা, যা গাজার শিশুদের যুদ্ধ, ধ্বংস আর অসীম ক্ষতির মধ্যেও টিকে থাকতে, জয়ের আশায় এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। এগুলোই ওদের বেঁচে থাকার ও শেখার অনুপ্রেরণার প্রতীক।

শিক্ষার মাধ্যমে শিশুরা যুদ্ধের ট্রমা থেকে সেরে উঠতে পারে, পুনরায় নিরাপত্তাবোধ ফিরে পেতে পারে। শেখার মধ্য দিয়েই তারা আত্মবিশ্বাস ও ভবিষ্যতের আশার আলো পুনরুদ্ধার করতে পারে, যা একদিকে ব্যক্তিগত পুনর্গঠনের জন্য, অন্যদিকে সমাজের সামগ্রিক পুনর্জীবনের জন্য অপরিহার্য।

এই শিশুরা, যারা টানা দুই বছর শিক্ষা অর্জন থেকে বঞ্চিত; আমাদের এখন দরকার তারা যেন আবার লিখতে পারে, শিখতে পারে, স্বপ্ন দেখতে পারে।

নাদা হামদোনা
একজন বহুভাষী অনুবাদক ও ভাষাশিক্ষক। তিনি আরবি, ইংরেজি ও তুর্কি ভাষায় কাজ করেন। তিনি ইংরেজি ভাষা ও শিক্ষায় স্নাতক ডিগ্রিধারী এবং বর্তমানে আল-আকসা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও কূটনীতি বিষয়ে স্নাতকোত্তর অধ্যয়নরত।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ রকম আরো সংবাদ...
https://slotbet.online/