• শনিবার, ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ০১:৫১ পূর্বাহ্ন

দুই নিয়ম এক সাগরে !

মো: বাদল হোসেন, পটুয়াখালী / ১৯ পড়া হয়েছে
প্রকাশিত : মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৫

একই সমুদ্র, কিন্তু নিয়ম আলাদা। এক পাশে নিষেধাজ্ঞা, আরেক পাশে অবাধ মাছ ধরা। বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ অংশে মা ইলিশ রক্ষায় চলছে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা। অথচ পাশের দেশ ভারতের জলসীমায় নেই তেমন কোনো কঠোরতা। ফলে বাংলাদেশের জেলেরা যখন ঘরে বসে দিন গুনছেন, তখন ভারতীয় ট্রলার চলছে সমুদ্রে দেদারসে মাছ ধরতে।

গত ৪ অক্টোবর থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত নদী ও সমুদ্রে ইলিশ ধরা বন্ধ রেখেছে বাংলাদেশ সরকার। প্রতিদিন অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ, কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী ও মৎস্য বিভাগ। কিন্তু উপকূলের জেলেরা বলছেন, এই সময়ে ফাঁকা সাগরে ভারতীয় ট্রলার প্রায়ই ঢুকে পড়ছে বাংলাদেশের জলসীমায়।

রাঙ্গাবালী উপজেলার  জেলে আব্দুল কাদের  বলেন, ‘আমরা সরকারের নিয়ম মেনে বসে আছি। কিন্তু দেখি ভারতীয় ট্রলার আসে, মাছ ধরে নিয়ে যায়। এতে আমাদের কষ্টটা আরও বাড়ে।

এক সাগরে দুই নিয়ম:

মা ইলিশ রক্ষায় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার কোন নিষেধাজ্ঞা দেননি। তবে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এ বছর ২ থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত মাত্র ১১ দিনের জন্য নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।। তাও আবার কেবল নদীকেন্দ্রিক। ফলে একই সাগরে দুই নিয়ম চলছে। এক দেশের জেলে মাছ ধরছে, আরেক দেশের জেলে তীরে বসে দিন কাটাচ্ছে খেয়ে না খেয়ে।

বিশ্বের মোট ইলিশের ৮৬ শতাংশ উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। ভারত এবং মিয়ানমারের অংশে মাত্র ১৪ শতাংশ। গবেষকদের মতে, এক দেশের কঠোরতা আর অন্য দেশের শৈথিল্য। দুটোর ফারাকেই ভেস্তে যাচ্ছে মা ইলিশ রক্ষার মূল উদ্দেশ্য।

বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ:

শের-ই-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক মেরিন ফিশারিজ অ্যান্ড একোয়া কালচার বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান  সহযোগী অধ্যাপক মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘ইলিশের জীবনচক্র মূলত অভিন্ন। সে বাংলাদেশ বা ভারতের জলসীমায় আলাদা করে প্রজনন করে না। একটানা এই সাগরেই তারা চলাচল করে। ফলে এক দেশে নিষেধাজ্ঞা, অন্য দেশে অবাধ শিকার— এতে মা ইলিশের সংরক্ষণ অসম্পূর্ণ থেকে যায়।”
তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশের জেলেরা নিয়ম মেনে বসে থাকলেও, ভারতীয় ট্রলার সমুদ্রে মাছ ধরে। এতে শুধু আমাদের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ইলিশ উৎপাদনও হুমকির মুখে পড়ে। সাগর সবার, তাই নিয়মও হওয়া উচিত এক।’

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সাজেদুল হক বলেন, ‘ইলিশের প্রজননকালে বঙ্গোপসাগরে একটি আঞ্চলিক ‘ইকো-অ্যালায়েন্স’ গঠন করা জরুরি। অর্থাৎ বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারকে সমন্বিত নীতিতে আসতে হবে। এতে ইলিশের প্রজনন ও মজুত দুটোই টেকসইভাবে রক্ষা করা সম্ভব হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের শুধু নিষেধাজ্ঞা নয়, পর্যবেক্ষণ প্রযুক্তিও উন্নত করতে হবে। স্যাটেলাইট মনিটরিং, ক্রস-বর্ডার কো-অর্ডিনেশন ও জেলে পর্যায়ে সচেতনতা— এই তিন ধাপ নিশ্চিত করতে পারলে ইলিশ সংরক্ষণে সফলতা বহুগুণে বাড়বে।’

সরকারি উদ্যোগ :
তবে ইতিবাচক দিকও আছে। এ বছরই প্রথমবার পাশ্ববর্তী দেশ গুলোর সঙ্গে মিল রেখে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞাকে ৫৮ দিন করার পাশাপাশি নতুন সময়সীমা নির্ধারণ করেছে সরকার।  বাংলাদেশের মতো ভারত ও মিয়ানমারও এপ্রিল-জুনে একযোগে ৫৮ দিনের সমুদ্র নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করায় স্বস্তি ফিরেছে জেলে সমাজে।

জেলেরা চান, অক্টোবরে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞাও যেন পাশের দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে বাস্তবায়ন হয়।
এদিকে নিষেধাজ্ঞা শুরু হলেও উপকূলের অনেক জেলে এখনো পাননি সরকারি খাদ্য সহায়তা। এতে উপকূলের দরিদ্র জেলে পরিবারের দিন কাটছে খেয়ে না খেয়ে।

মৎস্য বিভাগের তথ্যমতে, পটুয়াখালী জেলায় নিবন্ধিত জেলে আছেন প্রায় ৮০ হাজার। এর মধ্যে ৬৯ হাজার ৪৩ জনকে খাদ্য সহায়তার আওতায় আনা হয়েছে। তবে বিতরণ শুরু হতে দেরি হওয়ায় জেলেদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম বলেন, ‘২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য করার বিষয়টি আমরা পর্যালোচনা করছি। খাদ্য সহায়তাও দ্রুত বিতরণ করা হবে।’

একই সাগরে দুই নিয়ম— এতে যেমন উপকূলের জেলেরা বঞ্চিত, তেমনি ব্যাহত হচ্ছে ইলিশের প্রজননও।
বঙ্গোপসাগরের সম্পদ রক্ষায় এখন সময় এসেছে আঞ্চলিক ঐক্যের।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ রকম আরো সংবাদ...
https://slotbet.online/