• বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ০২:১০ পূর্বাহ্ন

কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বন্দরের প্রভাবে ইলিশের অস্তিত্ব সংকট

এ এম মিজানুর রহমান বুলেট, কলাপাড়া / ১১ পড়া হয়েছে
প্রকাশিত : মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর, ২০২৫

জাতীয় মাছ ইলিশের অস্তিত্ব রক্ষা এবং উপকূলীয় পরিবেশ সুরক্ষার দাবিতে ১০ নভেম্বর সকাল ১০ টায় পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় আন্ধারমানিক নদিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিবেশ ও উন্নয়ন ফোরাম- পটুয়াখালী, প্রান্তজন, ক্লিন এবং বিডব্লিউজিইডি এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই শুনানিতে এলাকার জেলে পরিবার এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। গণশুনানিতে বক্তারা স্পষ্ট করে তুলে ধরেন যে, কলাপাড়া অঞ্চলে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বন্দর কেন্দ্রিক অপরিকল্পিত মেগা উন্নয়ন ইলিশের অভয়াশ্রম আন্ধারমানিক নদীকে আজ ইলিশশূন্য হওয়ার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে।

গণশুনানীর বিচারক প্যানেলে ছিলেন ড. মোহাম্মদ আশরাফুল হক, উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও উপকেন্দ্র প্রধান, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, নদী উপকেন্দ্র, খেপুপাড়া; অসীম আবরার, প্রভাষক, উপকূলীয় অধ্যয়ন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়; শুভঙ্কর চক্রবর্তী, সদস্য, বরিশাল বিভাগীয় পরিবেশ ও জনসুরক্ষা ফোরাম; এডভোকেট সুভাস চন্দ্র দাস; মেজবাহউদ্দিন মাননু; সদস্য, প্রতিবেশ ও উন্নয়ন ফোরাম-পটুয়াখালী;

আলোচনা করেন, অমল মুখার্জী, আহ্বায়ক, প্রতিবেশ ও উন্নয়ন ফোরাম-পটুয়াখালী; তৌহিদুল ইসলাম শাহজাদা, নির্বাহী পরিচালক, প্রান্তজন; সদস্য সচিব; প্রতিবেশ ও উন্নয়ন ফোরাম-পটুয়াখালী

জেলেদের পরিবারের মধ্যে আলোচনা করেন, মন্নান পলহান, আব্দুর রব রাঢ়ী, আকলিমা; চন্দ্র ভানু, জহিরুল ইসলাম

জেলে আব্দুর রব রাঢ়ী বলেন, আমি প্রায় ৫৫ বছর ধইররা মাছ ধরি। মধুপাড়া, চর নিশানবাড়িয়া, দেবপুর, ছোনখোলা গ্রামে আমার মতোন ১০০০ জাইললা এক সময় রামনাবাদ নদীতে মাছ ধইররা হ্যাগো সংসার চালাইতে । এহন রামনাবাদ নদীর পায়রা বন্দরের চ্যানেল কইরা আমাগো  মাছ ধরা বন্ধ কইররা দেছে কিন্তু কোন ক্ষয়ক্ষতি দেয়নাই। এহন আমাগো বাইচচা থাহাই কষ্টমাছ ধরা বন্ধ করে দিয়েছে কিন্তু কোন ক্ষতিপূরণ দেয়নি। এখন আমাদের বেঁচে থাকাই কষ্ট।

আয়োজক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে জানানো হয়, জাতীয় মাছ ইলিশের উৎপাদন দিন দিন কমছে: ২০২০—২১ অর্থবছর পর্যন্ত উৎপাদন স্থিতিশীল থাকলেও ২০২২—২৩ অর্থবছর থেকে ২০২৩—২৪ অর্থবছরে এসে ইলিশের জাতীয় উৎপাদন ৪২,০০০ মেট্রিক টন কমে গেছে (প্রায় ৮% হ্রাস), যা গত ছয় বছরের মধ্যে ইলিশ উৎপাদন তলানিতে নেমে আসার ইঙ্গিত। দেশের মোট ইলিশের প্রায় ৬৫% উৎপাদনকারী বরিশাল বিভাগেও ২০২৩—২৪ অর্থবছরে উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে (প্রায় ২৩,৫০৯ মেট্রিক টন হ্রাস)। একসময়ের অফুরন্ত ভান্ডার আন্ধারমানিক নদ আজ গভীর সংকটের মুখে, এবং ২০১১ সালে অভয়াশ্রম ঘোষিত এই নদীতে বর্তমানে কালেভদ্রেও ইলিশ মিলছে না।

এই গভীর সংকটের কেন্দ্রে রয়েছে এই অঞ্চলের কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বন্দর কেন্দ্রিক অপরিকল্পিত উন্নয়ন। বক্তারা জোর দিয়ে বলেন যে, বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ অন্যান্য অবকাঠামো থেকে নির্গত অপরিশোধিত শিল্প বর্জ্য ও গরম পানি সরাসরি নদীতে পড়ছে। মৎস্য বিশেষজ্ঞদের মতে, ইলিশ অত্যন্ত দূষণ সংবেদনশীল হওয়ায় এই দূষণ তার প্রজনন ব্যাহত করছে, যার ফলে ইলিশের আকার ছোট হচ্ছে এবং তারা এলাকা ছাড়ছে। এই দূষণের কারণে রামনাবাদ, আন্ধারমানিক ও টিয়াখালী নদীর পানি ও মাটি মাঝারি থেকে উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। পাশাপাশি, বন্দরকে কেন্দ্র করে নদীতে অতিরিক্ত জাহাজ চলাচল বৃদ্ধি পাওয়ায় ইলিশের বঙ্গোপসাগর থেকে মূল প্রবেশ পথ প্রায় অবরুদ্ধ হচ্ছে। এছাড়াও আন্দারমানিক নদীতে মাত্র ৮ থেকে ১০ কিলোমিটারের মধ্যে একের পর এক তিনটি সেতু নির্মাণ এবং শাখা নদীগুলোর মুখ বন্ধ হওয়ায় নদীর স্বাভাবিক স্রোত বাধাগ্রস্থ হয়ে নাব্যতা কমেছে, যা ইলিশের অবাধ বিচরণ ও প্রজননকে মারাত্মকভাবে বাধা দিচ্ছে। এছাড়াও, নদীর তীর ভরাট করে ফ্রি—স্টাইলে বালু ফেলা এবং অবৈধ দখলদারিত্ব চলছে, যা নদীটিকে অস্তিত্ব সংকটে ফেলেছে।

এই পরিবেশগত বিপর্যয় জেলেদের জীবন ও জীবিকাকে চরমভাবে বিপন্ন করেছে। স্থানীয় জেলে পরিবারের প্রতিনিধিরা হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, জীবিকা নির্বাহের সুযোগ কমে যাওয়ায় শত শত জেলে পেশা বদলাতে বাধ্য হচ্ছেন, যা এই সংকটের গভীরতা প্রমাণ করে।

এই গুরুতর পরিবেশগত সংকটের সমাধান এবং জাতীয় সম্পদ ইলিশ রক্ষায় গণশুনানি থেকে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জরুরি ভিত্তিতে দাবি জানানো হয়েছে: বিদ্যুৎকেন্দ্রের বর্জ্য ও গরম পানি নদীতে ফেলার বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানের কঠোর পরিবেশগত মানদন্ড নিশ্চিত করতে হবে এবং মৎস্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শক্রমে ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্র সুরক্ষিত রেখে অবকাঠামোগত পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে হবে। এছাড়াও, জাহাজ চলাচল এবং অবকাঠামো নির্মাণ যেন ইলিশের প্রজনন ও চলাচলের পথকে বাধাগ্রস্থ না করে, তা নিশ্চিত করতে হবে এবং যেকোনো মেগা প্রকল্পের চূড়ান্ত অনুমোদনের আগে ইলিশসহ সামুদ্রিক জীববৈচিত্রের উপর পরিবেশগত প্রভাবের মূল্যায়ন অবশ্যই করতে হবে। সবশেষে, আন্ধারমানিক নদীর সীমানা চিহ্নিত করে অবিলম্বে দখল, দূষণ ও ভরাট বন্ধ করতে হবে এবং পলি অপসারণ করে নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। আয়োজক সংস্থা আশা প্রকাশ কেও যে, এই গণশুনানি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কলাপাড়ার পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় অবিলম্বে কার্যকরী ও কঠোর ভূমিকা নিতে বাধ্য করবে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ রকম আরো সংবাদ...
https://slotbet.online/